
ইরান-ইসরায়েল একসময় বন্ধুত্বের সম্পর্কে থাকলেও চার দশক
ধরে দুই দেশের সম্পর্ককে বর্ণনা করা হয় চিরশত্রু হিসেবে।
কিন্তু ইসরায়েল যখন হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছে, তখন অনেকের মধ্যেই এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, এই যুদ্ধ হয়তো শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
কিন্তু ইরান কি সত্যিই এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে? ইরান কেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এতো সোচ্চার? আর দুই দেশের মধ্যে চরম বৈরি সম্পর্কই বা কেন তৈরি হলো?
ইরান-ইসরায়েল এখন পরস্পরের শত্রু দেশ হলেও, অতীতে কিন্তু পরিস্থিতি এমনটা ছিলো না।
এমনকি ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, তখন তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশ ছিলো ইরান।
ইসরায়েলকে দেশটি এই স্বীকৃতি দেয় ১৯৫০ সালে।
ক্রমে দুই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক, এমনকি সামরিক সম্পর্কও। এরপর ১৯৫৭ সালে যখন ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘সাভাক’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এতে সহায়তা করেছিলো ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী
ইরানের সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেও ইরানের ভেতরে আগে থেকেই ইসরায়েল বিরোধিতা ছিলো।
ইরানের শাহ শাসন বিরোধী বামপন্থীদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন ফাতাহ এবং এর নেতা ইয়াসির আরাফাতের যোগাযোগ ছিলো।
অন্যদিকে, আয়াতুল্লাহ খোমেনী এবং তার অনুসারীরাও ছিলেন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে।
তবে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়ে মূলত ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর।
তখন ক্ষমতায় আসা ইরানের বিপ্লবী সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেয়ার ঘোষণা দেয় এবং তেহরানে ইসরায়েলের দূতাবাসকে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে পরিণত করে। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
মূলত ইরানের বিপ্লবী সরকার ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্স এর শিক্ষক এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আব্বাস ফয়েজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ইরানি সরকারের ইসরায়েল নীতি পরিবর্তন হওয়ার কারণেই দুই দেশের সম্পর্ক বৈরি হতে শুরু করে।
তিনি বলেন, “ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান সরকার আমেরিকা এবং ইসরায়েলকে তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেয়ার নীতিও নিয়েছিলো।
হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
অন্য আরব দেশগুলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানে একমত হলেও ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী সেটা গ্রহণযোগ্য মনে করেননি।
তারা ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে অস্বীকারের নীতি নেয়। অন্যদিকে ইরানের এমন উত্থানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে ইসরায়েল।”
তারা ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে অস্বীকারের নীতি নেয়। অন্যদিকে ইরানের এমন উত্থানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে ইসরায়েল।”
এখানে কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, ইরানের দূরপাল্লার মিসাইল তৈরির চেষ্টা।
দ্বিতীয়ত, পরমাণু প্রকল্প গ্রহণ।
তার প্রতি বৈরি হয়ে পড়া ইরানের এমন দুটি সামরিক প্রকল্পকে হুমকি হিসেবে দেখেছে ইসরায়েল। ফলে তারা ইরানের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিশেষত পরমাণু প্রকল্প ভেস্তে দিতে শুরু করে নানা অন্তর্ঘাতমূলত পদক্ষেপ।
এসময় দেশটির একের পর এক বিজ্ঞানীকে ইসরায়েল হত্যা করেছে বলেই ইরানের অভিযোগ।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার প্রভাব বলয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়।
লেবাননে ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় গড়ে ওঠে হেজবুল্লাহ। নব্বইয়ের দশকে হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকেও সহায়তা করতে শুরু করে ইসরায়েল।
যেটা দুই দেশের সম্পর্ককে আরো খারাপের দিকেই নিয়ে যায় বলে মনে করেন ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক।
“ইসরায়েল ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে আগ্রহী ছিলো না। তারা শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।কিন্তু ইরান সরকারের নীতির কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। পরে ইসরায়েল চেষ্টা করেছে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম চালিয়ে ইরানের পরমাণু প্রকল্পকে ব্যাহত করতে।”
কিন্তু তিনি বলছেন, সে চেষ্টাটা আসলে কাজ করেনি। এতে দুই দেশের সম্পর্ক আরো তলানিতে গিয়েছে।
কিন্তু তিনি বলছেন, সে চেষ্টাটা আসলে কাজ করেনি। এতে দুই দেশের সম্পর্ক আরো তলানিতে গিয়েছে।
ইসরায়েল কেন ইরানকে হুমকি মনে করে?
ইসরায়েল ইরানের অস্ত্র কর্মসূচিকে সবসময়ই হুমকি হিসেবে দেখে এসেছে। এমনকি ইসরায়েল ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা করার হুমকিও দিয়েছে একাধিকবার।
যদিও ইরান দাবি করে তাদের পরমাণু কর্মসূচি অস্ত্র বানানোর জন্য নয়, বরং শান্তিপূর্ণ।
কিন্তু সামরিকভাবে ইরানের চেয়ে শক্তিশালী এবং আমেরিকা-ইউরোপের সমর্থন সত্ত্বেও ইসরায়েল কেন ইরানকে হুমকি মনে করে? ইরান কি আসলেই ইসরায়েলের জন্য হুমকি?
মেইর লিটভ্যাক তেমনটাই মনে করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি ইসরায়েলের ছোট আয়তনের কথা বলছেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “দেখুন, ইরান ইসরায়েলের চেয়ে আয়তনে অনেক বড়। এর জনসংখ্যাও ইসরায়েলের দশ গুন বেশি। ফলে ইরানকে একটা যুদ্ধের মাধ্যমে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।”
তিনি আরো বলেন, “কিন্তু একটা বড় যুদ্ধে অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য ইসরায়েল বেশ ছোট দেশ। এর জনসংখ্যাও কম। এছাড়া ইসরায়েলের মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম আছে, কিন্তু সেটা ইরানের সর্বাত্মক মিসাইল হামলা ঠেকানোর মতো নয়।"
"সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ইরানের মতো একটা দেশ যখন ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার ঘোষণা দেয়, এবং সে দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে ফেলে তাহলে এই ভয় থাকবেই যে সে এটা কোন একদিন ব্যবহার করলেও করতে পারে,” বলছেন মেইর লিটভ্যাক।
ইরান আগে থেকেই ইসরায়েলের সম্ভাব্য সামরিক হামলা মোকাবিলায় মধ্যপ্রাচ্যে নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরি করে নিয়েছে।
ইসরায়েলের পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন এবং সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করেছে তেহরান।
একইসঙ্গে গাজায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকে অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তাও দেয় দেশটি।
তুরস্কের সমরবিদ ড. মুরাত আসলান বলেন, ইরান ইসরায়েলের ভূখণ্ডে সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম।
এটা সে দুইভাবে করতে পারে- হেজবুল্লাহ’র মিলিশিয়া বাহিনী দিয়ে সরাসরি আক্রমণ কিংবা উচ্চপ্রযুক্তির মিসাইল হামলার মাধ্যমে।
তবে ইসরায়েল এর আগে লেবানন কিংবা সিরিয়ায় ইরানের সন্দেহজনক অবস্থানে হামলা করলেও সেটি সেই অর্থে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের হুমকি তৈরি করেনি।
ইরান সেটা নিজের উপর হামলা হিসেবে বিবেচনা করেনি।
যদিও ইসরায়েল-হামাসের সাম্প্রতিক যুদ্ধের কারণে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে।
কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে, ইসরায়েল-হামাস চলমান যুদ্ধে ইরান কি সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারে?
ইরান-ইসরায়েলের প্রতিনিধি
মি. আসলানের মত হচ্ছে, ইরান সেই ঝুঁকি নেবে না।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “ইরানি নেতৃত্বের নীতি হচ্ছে, অন্যের যুদ্ধে সরাসরি না জড়ানো। সুতরাং এখানেও সেটাই ঘটবে।
আর ইসরায়েল কিংবা আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার মতো অবস্থাও নেই ইরানের। দেশটি তাদের সহযোগী শক্তিগুলোকেই মূলতঃ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকবে।”
মুরাত আসলান বলছেন, ইরানের ভেতরেও বিভিন্ন শক্তিশালী বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় আছে। ইরান বাইরের যুদ্ধে জড়ালে বিদ্রোহীরা সেই সুযোগ নেবে।
এছাড়া ইরানের ভেতরে সরকার বিরোধী বিক্ষাভও আছে।
সাম্প্রতিককালে মাশা আমিনির মৃত্যুর পরে যে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি হয়েছিলো, সেটা ইরানের সরকারকে যথেষ্ট টালমাটাল করে ফেলেছিলো।
সুতরাং সেখানকার সরকার বাইরের বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে ভেতর থেকে অস্তিত্বের সংকটে পড়তে চাইবে না।
ইসরায়েল-ইরান পরস্পর বৈরি দেশ এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এটাও মনে করা হয় দুই দেশের কেউই একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি নেবে না।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে দুই দেশের যে কোন ভুল পদক্ষেপ পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে দিতে পারে। শঙ্কাটা এখানেই।
মি. আসলানের মত হচ্ছে, ইরান সেই ঝুঁকি নেবে না।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “ইরানি নেতৃত্বের নীতি হচ্ছে, অন্যের যুদ্ধে সরাসরি না জড়ানো। সুতরাং এখানেও সেটাই ঘটবে।
আর ইসরায়েল কিংবা আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার মতো অবস্থাও নেই ইরানের। দেশটি তাদের সহযোগী শক্তিগুলোকেই মূলতঃ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকবে।”
মুরাত আসলান বলছেন, ইরানের ভেতরেও বিভিন্ন শক্তিশালী বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় আছে। ইরান বাইরের যুদ্ধে জড়ালে বিদ্রোহীরা সেই সুযোগ নেবে।
এছাড়া ইরানের ভেতরে সরকার বিরোধী বিক্ষাভও আছে।
সাম্প্রতিককালে মাশা আমিনির মৃত্যুর পরে যে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি হয়েছিলো, সেটা ইরানের সরকারকে যথেষ্ট টালমাটাল করে ফেলেছিলো।
সুতরাং সেখানকার সরকার বাইরের বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে ভেতর থেকে অস্তিত্বের সংকটে পড়তে চাইবে না।
ইসরায়েল-ইরান পরস্পর বৈরি দেশ এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এটাও মনে করা হয় দুই দেশের কেউই একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি নেবে না।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে দুই দেশের যে কোন ভুল পদক্ষেপ পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে দিতে পারে। শঙ্কাটা এখানেই।
0 Comments