বাংলাদেশি বিজ্ঞানী কিংবা অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন এরকম বিজ্ঞানীর সংখ্যা খুব কি বেশি? ফজলুর রহমান খান, কুদরত-ই-খুদা, ওয়াজেদ মিয়া, জামাল নজরুল ইসলাম, মাকসুদুল আলম এবং আর হাতে গোনা কয়েকজনের নাম বললেই তালিকা শেষ। অনেকে ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নেওয়া জগদীশ চন্দ্র বসুকেও আমাদের বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদেরই নিজেদের বিজ্ঞানী, আমাদের দেশেই লেখাপড়া করেছেন, পরবর্তীতে আমেরিকা গিয়ে নানামুখী গবেষণা করে বিজ্ঞানসমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই লোকটির নাম আমরা সকলেই ভুলে যেতে বসেছি। প্রাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকা এ বিজ্ঞানীর নাম আবদুস সাত্তার খান।
ভাবতেই খারাপ লাগে, আফসোস হয়....আজ গা জা র উপর ইসরাইলি বিমানগুলো বোমা নিক্ষেপের সুযোগ পাচ্ছে কারণ একটা সময় রাতের পর রাত জেগে, বউয়ের সাথে ঝগড়া করে কোনো এক বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মনোযোগ দিয়েছিলেন ফাইটার জেটের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী ইঞ্জিনের সবচেয়ে সফিস্টিকেটেড পার্ট তৈরীর প্রতি!
জ্বি, বিজ্ঞানী আব্দুস সাত্তার খানের কথাই বলছি। Pratt & Whitney F100 ইঞ্জিন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ইঞ্জিনের সংকর ধাতুর কাজটি জেট ইঞ্জিনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, যা কিনা কপি করা খুব কষ্টকর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত উতকর্ষতা বলতে যা বোঝায়, তার মাঝে একটি হচ্ছে এই সংকর ধাতুর প্রযুক্তি। জেট ইঞ্জিনে ব্যবহৃত হয় বলেই বিশ্বে নিকেল খনিগুলি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্র্যাট এন্ড হুইটনি কম্পানিতে সাত্তার হয়েছিলেন চিফ ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৮৬ সালে F-15 এবং F-16 এর ইঞ্জিনের জ্বালানি খরচ কমানোয় বিশেষ অবদান রাখার জন্য পান ইউনাইটেড টেকনোলজিস (প্র্যাট এন্ড হুইটনির প্যারেন্ট কোম্পানি) স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড। ১৯৯৪ সালে উচ্চগতিসম্পন্ন জেট বিমানের ইঞ্জিন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে অবদানের জন্য ইউনাইটেড টেকনোলজিস রিসার্চ সেন্টার অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স পদক লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে পান ‘প্রাট অ্যান্ড হুইটনি’র বিশেষ অ্যাওয়ার্ড।
শুধুমাত্র F-15, F-16 না। যুক্তরাষ্ট্রের স্টিলথ ফাইটার F-35 এর ইন্টারনাল ওয়েপন বে'র হ্যাচ ডিজাইনারও একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী।
আগে এসব বিজ্ঞানীদের নিয়ে গর্ব হত, এখন আর হয়না। কারণ হিসেবে বলতে হয়, তাদের মেজর কন্ট্রিবিউশানে তৈরী বিমানগুলোই আজ হাজার হাজার মুসলিমের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। এর দায়ভার কি আব্দুস সাত্তার খান নিবেন? হয়ত না। তাকে দোষারোপ করাও ঠিক হবেনা।
তবে এই ঘটনার মাধ্যমে একটা প্রশ্ন আমরা উত্থাপন করতেই পারি, “আপনার মেধা আপনি কাকে দিবেন”? যদি ভেবে চিন্তে জেনে বুঝে জালেমকে মেধা দিয়েও সাহায্য করেন, কাল কিয়ামতের ময়দানে মজলুমের রক্তের হিসেব চুকাতে আপনাকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
কে এই আব্দুস সাত্তার?
বিজ্ঞানী আব্দুস সাত্তার
আব্দুস সাত্তার খান ১৯৪১ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় নবীনগর উপজেলার খাগাতুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সাত্তারের জন্মের নির্দিষ্ট তারিখটিও সংরক্ষিত করা হয়নি। মাত্র আট বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। এজন্য সাত্তারের মা তাঁকে নিয়ে পিত্রালয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। তখনকার আট দশটা ছেলে-মেয়ের মতোই বেড়ে উঠতে থাকেন সাত্তার খান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জন্য তাঁকে যেতে হতো কয়েক মাইল দুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছোট বেলা থেকে মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছেন জ্ঞানার্জনের অনন্য স্পৃহা।
প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে বোর্ড স্ট্যান্ড করেন মাধ্যমিকে রতনপুর আবদুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। আর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ালেখা শেষ করে সুযোগ পান দেশ সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগ থেকে ১৯৬২ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৬৪ সালে ডক্টরেট করতে যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সালে রসায়নের উপর ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করে ফেলেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে হানাদার বাহিনীর নির্মম আক্রোশের শিকার হতে পারতেন সাত্তার। যখন বুঝতে পারলেন পাক সেনারা চলে এসেছে, ততক্ষণে বাইরে পালানোর আর কোনো উপায় নেই। তাই হতবুদ্ধি হয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলেন খাটের নীচে।
১৯৭৩ সালে সাত্তার খান সংকর ধাতু নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য দেশ ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এএমএস গবেষণাগারে ২ বছরের জন্য যোগ দেন। ঐ সময়টা ছিল জেট ইঞ্জিনের উন্নয়নকাল।
আব্দুস সাত্তার খান গবেষণায় দুর্দান্ত সাফল্য পান। আইওয়াতে আড়াই বছরের গবেষণায় ১০-এর অধিক অ্যালয় তথা সংকর ধাতু তৈরি করেন। তিনি নাসা ইউনাইটেড টেকনোলজিস এবং অ্যালস্টমে কাজ করার সময়ে ৪০টিরও বেশি সংকর ধাতু উদ্ভাবন করেছেন। এসব অ্যালয় উচ্চ তাপমাত্রায় ব্যবহার উপযোগী।
১৯৭৬ সালে নাসার লুইস রিসার্চ সেন্টারে গবেষণা শুরু করেন আব্দুস সাত্তার খান। এখানে এসে তিনি মহাকাশযানে ব্যবহারোপযোগী সংকর ধাতু নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার গবেষণার ফলস্বরূপ তিনি পান নিকেল ও অ্যালুমিনিয়ামের একপ্রকার অত্যন্ত উন্নতমানের সংকর। এই ধাতু বিমানের জ্বালানী সাশ্রয় করে, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে এবং কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া এসব ধাতুর ব্যবহার ছিল রকেটেও।
সাত্তার খানের উদ্ভাবিত সংকর ধাতুগুলো এফ-১৬ ও এফ-১৭ যুদ্ধবিমানের জ্বালানি সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মার্কিন বিমান বাহিনীর জন্য দ্রুতগতির এফ-১৫ ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান তৈরির কাজে সরাসরি নিযুক্ত হন তিনি। ৭০-এর দশকে বিমান তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় সাত্তার খান জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান প্রাট অ্যান্ড হুইটনির নজরে আসেন। এজন্য এ কোম্পানি সাত্তার খানকে গবেষণার জন্য অর্থায়ন করে।
আব্দুস সাত্তার খানের কিছু গবেষণার কথা না বললেই নয়, যা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এখনো ব্যবহৃত হয়ে আসছে-
কাটিং-এজ জেট ইঞ্জিনের জ্বালানি বাষ্পে তাঁর তৈরি ন্যানো-ক্যাটালিস্ট ব্যবহার করা হয়, যা অর্থসাশ্রয়ী।
তাঁর গবেষণা যুদ্ধ বিমানের ইঞ্জিনকে জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী করার ফলে যুদ্ধবিমান অধিক দূরত্ব অতিক্রম করতে পারছে।
প্রাট অ্যান্ড হুইটনিতে থাকাকালীন তার গবেষণায় প্রাপ্ত তাপীয় অবসাদ ও ক্ষয়রোধী প্রলেপ দেয়ার পদ্ধতি চালু হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সাফল্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
আলস্টম কোম্পানির ব্যবহৃত গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন উন্নয়নে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি।
আলস্টমের অত্যাধুনিক জি-১১ গ্যাস টারবাইনে ব্যবহৃত হচ্ছে তাঁর আবিষ্কৃত জারণরোধী প্রলেপযুক্ত যন্ত্রাংশ।
একুশ শতকের আগমনের সাথে সাথে কর্মস্থল পরিবর্তন করেন আবদুস সাত্তার খান। তিনি বলেছিলেন, একস্থানে কাজ করে একঘেয়েমি ধরে গিয়েছিল তার। প্রাট অ্যান্ড হুইটনি ছড়ে দিয়ে যোগ দিলেন সুইজারল্যান্ডের আলস্টম কোম্পানিতে। তখন জ্বালানি উৎপাদনের জন্য এটিই বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে মাত্র পাঁচ বছর কাজ করেই নামের পাশে যোগ করেন ২৫টি পেটেন্ট এবং পুরো জীবনে তিনি ৩১ টি পেটেন্টের মালিক হয়েছেন।
গবেষণা এবং মহাকাশে তার প্রয়োগের জন্য তিনি নাসা, আমেরিকান বিমানবাহিনী, ইউনাইটেড টেকনোলজি এবং অ্যালস্টম থেকে আব্দুস সাত্তার খান অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০০৫ সাল থেকে যুক্তরাজ্য পেশাজীবী বিজ্ঞানী হিসেবে রয়েল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি এবং এর আগে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি থেকে ফেলো নির্বাচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব মেটালসেরও সদস্যপদ পান তিনি।
বাংলার মানুষের কথা ভেবে ১৯৯১ সালে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের জন্য বাংলাদেশের জন্য প্রায় ৬১০০০ ডলার সংগ্রহ করে রেড ক্রসের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পাঠান। দেশের মানুষের জন্য তিনি সাধ্য মত চেষ্টা করে গেছেন।
জীবনের বাকিটা সময় কাটিয়েছেন আমেরিকায়, সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়ে। ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি, ৬৭ বছর বয়সে আমেরিকার ফ্লোরিডায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমাদের দেশের এই মহান বিজ্ঞানীর নাম নয় শুধু তার কাজের জন্য বিশ্ববাসী যেমনি ভাবে সম্মান এবং তাঁকে স্মরণ করে, ঠিক তেমনি করে আমাদেরও তার সম্পর্কে এবং তার কাজ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

0 Comments