 |
আমাদের চোখে সামনে আমাদের ভাইদের সাথে পশুর মতো আচরণ করছে, আবার আমাদেরই মানবতার বুলি শেখাচ্ছে। FT এর এক ডিটেইলস আর্টিকেলে গাজায় ত্রাণের নামে যে মরণফাঁদ তৈরি করা হয়েছে, সেটি উঠে এসেছে |
গাজার ‘মরণফাঁদ’-এর ভেতরে জিহাদ ইতিমধ্যে পাঁচবার দক্ষিণ গাজার ভেতর দিয়ে হেঁটে
গেছে — ইসরায়েলি ট্যাংক, সেনা আর মাঝেমধ্যে ড্রোনের চোখ এড়িয়ে — গাজা
হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (GHF) সহায়তা কেন্দ্রে পৌঁছাতে। পাঁচবার সে খাঁচার
মতো গলিতে লাইন দিয়েছে, যেখানে হাজার হাজার পুরুষ হুড়োহুড়ি করে ছুটে যাচ্ছে যতটা
সম্ভব খাবার কেড়ে নেওয়ার জন্য। আর প্রতিবারই সে খালি হাতে ফিরেছে। জিহাদ জানান,
একবার খান ইউনিসে GHF-এর একটি কেন্দ্রে পৌঁছানোর পথে তার পাশ দিয়ে হাঁটছিল এমন একজন
গুলিবিদ্ধ হন: “তার রক্ত আর নাড়িভুঁড়ি আমার গায়ে এসে পড়ে।” আরেকবার, অনেক কষ্টে এক
বাক্স ত্রাণ সংগ্রহ করার পর, এক ফিলিস্তিনির ছুরির মুখে লুট হয়ে যায়। “আমি আর ওখানে
যাই না, কারণ যা ঘটে সেটা আপনার কল্পনারও বাইরে,” বলেন ২৬ বছর বয়সী এই চিকিৎসা
কর্মী, যে নিজের পুরো নাম প্রকাশ করতে চায়নি। GHF মে মাসে চালু হওয়ার পর থেকে
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই বিতর্কিত উদ্যোগকে গাজার জন্য লাইফ লাইন হিসেবে প্রচার
করেছে, যা গাজার অধিবাসীদের ক্ষুধার তীব্রতা কিছুটা লাঘব করতে পারে, জাতিসংঘকে পাশ
কাটিয়ে হামাসের হাতে সাহায্য পৌঁছানো বন্ধ করতে পারে। কিন্তু Financial Times-এর
সংগ্রহ করা সাক্ষ্য, স্যাটেলাইট চিত্র ও যাচাই করা ভিডিও দেখায় — জিহাদের মতো গাজার
২১ লাখ মানুষের অধিকাংশের জন্য এই উদ্যোগ শুধুই তাদের মরিয়া অবস্থাকে আরও ঘনীভূত
করেছে, আর ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের এমন বিপজ্জনক যাত্রায় ঠেলে দিয়েছে যেখান থেকে
অনেকেই আর ফিরতে পারেন না। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ইসরায়েলি বাহিনী বারবার GHF-এর
কেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার পথে থাকা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী এতে ৫০০-এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে হাজার
হাজার। অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে সেই নির্ধারিত রুটে, যেগুলো GHF নিজেই তাদের ফেসবুক
পেজে ম্যাপ দিয়ে প্রকাশ করে। কিন্তু গাজাবাসীরা — যাদের অনেকেই বহু মাস ধরে চলা
ইসরায়েলি অবরোধের ফলে দুর্ভিক্ষসীমায় পৌঁছে গেছে — জানায়, এই ব্যবস্থা কেবল তাদের
জীবন ঝুঁকিতে ফেলে না, বরং যথেষ্ট সাহায্যও দেয় না। তারা সবাই যেন খাবার ছিনিয়ে
নেওয়ার লড়াইয়ে পড়ে যায়। হাছান আব্দুল্লাহ নামে একজন বলেন, GHF-এর কেন্দ্রগুলো
“মরণফাঁদ”, যিনি তার পরিবারসহ দক্ষিণ উপকূলের আল-মাওয়াসিতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি
বলেন“যদি আপনি কিছু খাবার জোগাড় করতে পারেন এবং ইসরায়েলিদের গুলির হাত থেকে বাঁচেন,
তখনও বাইরে অপেক্ষায় থাকা গ্যাংদের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না। আব্দুল্লাহ সাতবার
গিয়ে একবারই কেবল ত্রাণ আনতে পেরেছেন। GHF, যা গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০ মিলিয়ন
ডলার সংগ্রহ করেছে। এই উদ্যোগে Boston Consulting Group (BCG) জড়িত ছিল, যদিও
প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তাদের কিছু কর্মী অনুমতি ছাড়া এই কাজ করেছে এবং সেই প্রকল্পে
নেতৃত্ব দেওয়া দুই অংশীদারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। GHF বর্তমানে দক্ষিণ গাজার চারটি
কেন্দ্রে কাজ করছে, যেখানে মার্কিন সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টররা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর
নজরদারিতে কাজ করছে। গাজাবাসীরা কখন কোথায় যেতে হবে সেটা জানতে হয় GHF-এর ফেসবুক
পোস্ট দেখে, যেখানে সহায়তা বিতরণের সময় জানানো হয়। FT-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, অনেক
পোস্ট মাঝরাতে দেওয়া হয়, কখনো কখনো ৩০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার
ঘোষণা চলে আসে। এমনও দেখা গেছে, কেন্দ্র খোলার আগেই বন্ধ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গাজার
ঘন ঘন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অনেকেই ফেসবুকে সেই পোস্ট দেখতেই পারেন না। কিন্তু
যাদের খাবার দরকার, তারা কিলোমিটারের পর কিলোমিটার এমন পথে হাঁটেন, যেগুলো এখন চেনা
কঠিন, এবং বোমায় গুঁড়িয়ে দেওয়া জায়গার মধ্য দিয়ে যেতে হয় — ফলে সামান্য ভুলেরও
সুযোগ নেই। জিহাদ বলেন“রাতের আঁধারে আপনি দেখতেই পান না কোথায় যাচ্ছেন। ম্যাপে
দেখানো পথ ফোনে দেখা গেলেও বাস্তবে সব রাস্তা ধ্বংস হয়ে গেছে, আপনাকে আন্দাজ করেই
চলতে হয়। তাই হয় আপনি সঠিক পথে আছেন, না হলে আপনি মারা যাবেন।” GHF কেন্দ্রগুলোতে
পৌঁছানোর পর মানুষকে নির্ধারিত এলাকায় অপেক্ষা করতে বলা হয়, যা প্রায়ই সক্রিয়
যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যেই পড়ে। এখানেই বিপদ সবচেয়ে বেশি। অনেক ফিলিস্তিনি বলেন, তারা
ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলির মুখে পড়েছেন — চারপাশে ভিড় বেড়ে যায়, সবাই ঠেলাঠেলি করে,
যাতে যতটা সম্ভব সামনে এগিয়ে খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানো যায়। মোহাম্মদ দাউদ,
যিনি যুদ্ধের আগে ফুল সাজানোর কাজ করতেন, বলেন, তিনি যতবার গিয়েছেন ততবারই গুলি
চলেছে। “এটা একবার বা দুইবার নয়। তারা সময় দেয় কখন গেট খুলবে, কিন্তু হঠাৎ করেই
ট্যাংক বা ড্রোন গুলি ছোড়ে।” MSF (Médecins Sans Frontières)-এর গাজা ইমারজেন্সি
কো-অর্ডিনেটর আইতোর জাবালগোগেজকোয়া বলেন, তিনি প্রতিদিন ভোরে “একদল সেনাবাহিনী”কে
GHF কেন্দ্রে যেতে দেখেন, তারপরেই গুলির শব্দ শুনতে পান। “তিনটা গুলি — ‘পা-পা-পা’,
তারপর অপেক্ষা — ‘পা-পা-পা’, আবার অপেক্ষা,” এরপর আহতরা পায়ে হেঁটে বা গাধার গাড়িতে
করে হাসপাতালে আসে। গোহার রহবর, একজন ব্রিটিশ সার্জন যিনি জুনে গাজার দক্ষিণের
নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন, তিন বলেন, হাসপাতালের
ছয়টি অপারেশন থিয়েটার প্রায়শই GHF কেন্দ্র থেকে ফিরে আসা গুলিবিদ্ধদের নিয়ে ভর্তি
থাকে। তিনি বলেন “সকাল ৭টা ৪৫-এর সার্জারির মিটিং চলাকালে হঠাৎ হাসপাতালের ম্যাস
ক্যাজুয়াল্টি অ্যালার্ম বেজে ওঠে,” বলেন তিনি। “আর তখনই আমরা অপারেশন থিয়েটারে
দৌড়াই।” Breaking the Silence নামক সাবেক ইসরায়েলি সেনাদের সংগঠনের জোয়েল কারমেল
বলেন, গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের নিয়মনীতির সাধারণ দিক হলো: “যদি কেউ ‘যুদ্ধ উপযোগী
বয়সের পুরুষ’ হয়... যদি তারা কাছাকাছি আসে, বা এমন জায়গায় ঢোকে যেখানে থাকার কথা
নয়, তাহলে আদেশ হয় ‘গুলি চালাও’।" আইডিএফ (ইসরায়েলি সেনাবাহিনী) স্বীকার করেছে,
তারা "হুমকিস্বরূপ" জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। তবে তারা অস্বীকার করেছে যে
তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তাদের দাবি, মৃত্যুর সংখ্যা
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যের চেয়ে অনেক কম। এক ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা
বলেন, GHF রুটগুলোতে চিহ্ন, বালির বাঁধ ও কাঁটাতারের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে চিহ্ন
দেওয়া আছে। “রাস্তার বাইরে থাকলে সেটা যুদ্ধক্ষেত্র... সেখানে আমাদের সৈন্যরা
প্রথমে সতর্কতা ছুঁড়বে, এরপর নিজেদের রক্ষা করবে।” আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি
জানিয়েছে, সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় খাবার বিতরণ কেন্দ্রের বাইরে ৩১ জন নিহত এবং
ডজনখানেক আহত হয়েছে, যা তাদের দক্ষিণ গাজার ফিল্ড হাসপাতালে সবচেয়ে বড় মৃত্যু
মিছিল। জাতিসংঘ ও প্রধান মানবিক সংস্থাগুলো, যারা যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় গাজায় ত্রাণ
বিতরণ চালিয়েছিল, তারা GHF-এর সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকার করেছে। তারা এই প্রকল্পকে
“ত্রাণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার” ও “ফিগ লিফ” হিসেবে বর্ণনা করেছে — যার মাধ্যমে
ফিলিস্তিনিদের উত্তর ও সেন্ট্রাল গাজা থেকে দক্ষিণে তাড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
করা হচ্ছে, যেমনটি ইসরায়েলি নেতারা প্রকাশ্যে বলেছিলেন। মানবিক সহায়তা কর্মীরা —
যারা ইসরায়েল মার্চে অবরোধ জারি করার আগে গাজায় প্রায় ৪০০টি বিতরণ কেন্দ্র পরিচালনা
করতেন, তারা বলেন, তারা হামাসের দ্বারা ত্রাণ ছিনতাইয়ের কোনও প্রমাণ পাননি।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা UNRWA-এর মুখপাত্র জুলিয়েট তৌমা বলেন, “আমরা যাদের সেবা
দিয়েছি তাদের রক্ষা করেছি। আমরা সরাসরি মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতাম... যেখানে
আশেপাশে কোনও সশস্ত্র ব্যক্তি থাকত না, এবং কোনও গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি।” GHF চালু
হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘ কেবল অল্পসংখ্যক ত্রাণ পাঠাতে পেরেছে, যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন
বৃহস্পতিবার জানিয়েছে যে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে জাতিসংঘের সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে
চুক্তিতে পৌঁছেছে। GHF-এর দাবি, গুলি ও হতাহতের ঘটনা তাদের বিতরণ কেন্দ্রের বাইরে
ঘটেছে এবং হামাস উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। তারা বলেছে, তারা ইসরায়েলের
ওপর চাপ দিচ্ছে যাতে আরও বেশি ত্রাণ প্রবাহ অনুমোদন করে এবং উত্তর ও মধ্য গাজায়
অতিরিক্ত কেন্দ্র খোলার অনুমতি দেয়। GHF, যাদের দাবি তারা ৭ কোটির বেশি বিনামূল্যে
খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছে, বলেছে তারা ক্রমাগত “উন্নয়ন করছে” — এর মধ্যে রয়েছে
“মহিলা ও শিশুদের জন্য আলাদা লেন” তৈরির কাজ। কিন্তু গাজায় অক্সফামের কর্মকর্তা
ক্রিস ম্যাকইন্টশ বলেন, GHF-এর কেন্দ্রগুলো “ত্রাণের জন্য নয়”, “এগুলো আসলে
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।” অনেক ফিলিস্তিনি
জানেন, তারা যতবারই GHF কেন্দ্রে যান না কেন, খালি হাতে ফেরার সম্ভাবনা বেশি। আরেফ
ফাররা, এক সাবেক কম্পিউটার সায়েন্স শিক্ষার্থী, বলেন, তিনি “সেকেন্ড ওয়েবে” প্রবেশ
করেন, যাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। কিন্তু তখন ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়, দেখা
যায় কার্টনের বাক্স ছেঁড়া, ভেতরের মূল্যবান জিনিস যেমন তেল নেই। দুবার সে খাবার
পেয়ে ফিরতে চাইলেও অন্যরা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। একবার সে চিনি পেয়েও পথে লুট হয়ে
যায়। ফাররা বলেন, “এটা আসলে শক্তিশালীর টিকে থাকার লড়াই। আপনি ভাবেন আগে আপনি কী
ছিলেন আর এখন কী — এখন আপনি যেন একটা প্রাণী, ছুটে বেড়াচ্ছেন খাবারের জন্য।”মূল প্রতিবেদকঃ Financial Times
0 Comments